প্রানীর মল বা (পায়খানা) থেকে তৈরি হয় বিশ্বের সবচেয়ে দামি খাবার।

                অনলাইন ডেস্কঃ

                     Time:12:30 pm


০৭ আষাঢ় ,১৪৩০ বঙ্গাব্দ,বর্ষাকাল,- বুধবার, ২১ জুন-২০২৩ খ্রিস্টাব্দ,০২ জ্বিলহজ্জ, ১৪৪৪ হিজরি।

কোপি লুয়াক: প্রাণীর মল থেকে তৈরি হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে দামী কফি ||




ইন্দোনেশিয়ায় প্রস্তুতকৃত পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কফির নাম ‘কোপি লুয়াক’। এক কাপ কোপি লুয়াকের দাম সর্বনিম্ন ৩৫ ডলার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১০০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে।

চাষ করা কফির ফল খেতে দেওয়া হয় পাম সিবেটকে বা গন্ধগোকুলকে। তারা বেছে বেছে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কফি ফলগুলোকে গিলে খেয়ে নেয়। কিন্তু বীজসহ কফি ফলের পুরোটা তাদের পরিপাকতন্ত্রে হজম হয় না। কফি ফলের মাংসল অংশ হজম হয়ে গেলেও বীজগুলো আস্তই থেকে যায়। এরপর পরিপাকনালীর মধ্যে কফির বীজগুলোর গাঁজন/ফার্মেন্টেশন শুরু হয়। এরপর প্রোটিয়েজ এনজাইম কফিশুটির ভিতর প্রবেশের মাধ্যমে ক্ষুদ্রতর পেপটাইড এবং অন্যান্য মুক্ত অ্যামিনো অ্যাসিড সংশ্লেষণ করে। এতে কফির বীজে যোগ হয় ক্যারামেলের ফ্লেভার বা এক প্রকারের সুগন্ধ। ফলে স্বাদ বেড়ে যায় লুয়াক কফির। পরে পাম সিবেট/গন্ধগোকুল মলত্যাগ করলে, তা থেকে আস্ত বীজগুলো সংগ্রহ করেন কফিশ্রমিকেরা। আর সে বীজগুলো পরিষ্কার করেই তৈরি করা হয় সবচেয়ে দামি কফি।



কফি লুয়াক – পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কফির গল্প


কখনও কি ভেবেছেন কোনো প্রাণীর মল পান করবেন? তাও আবার বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করে? অনেকটাই ঘাবড়ে যাবার মতো প্রশ্ন, তাইনা! ধরুণ আপনি কফি ভালোবাসেন। আপনাকে এক কাপ কফি দেওয়া হলো। ধোয়া ওঠা গরম কফি থেকে খুব সুঘ্রাণ বেরুচ্ছে। কিন্তু সেই সাথে এও বলে দেওয়া হলো, এই কফি বিন সংগ্রহ করা হয়েছে এক প্রাণীর মল থেকে! তাও আবার এই এক কাপ কফির দাম পড়বে তিন হাজার টাকা!  চোখ কপালে ওঠাটা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়।

বলছিলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কফির কথা। ইন্দোনেশিয়ায় তৈরি হওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে দামী এই কফিটির নাম, ‘কোপি লুয়াক’। এক কাপ ‘কপি লুয়াক’ এর দাম সর্বনিম্ন ৩৫ ডলার (বাংলাদেশী টাকায় প্রায় উনত্রিশশো টাকা) থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১০০ ডলার (৮ হাজার ৮শ’ টাকা) পর্যন্ত গুনতে হতে পারে। কেন এটি সবচেয়ে দামী?

কোপি লুয়াকের র ভার্সন;  Image Source: flickr

তার আগে বলি, কোপি একটা ইন্দোনেশিয়ান শব্দ। ইন্দোনেশিয়ানরা কফিকে কোপি বলে। আর পাম সিবেট বা পাম বিড়াল ইন্দোনেশিয়ায় লুয়াক নামে পরিচিত। এই হলো কোপি লুয়াকের নামকরণের কারণ। কোপি লুয়াককে ‘ক্যাট পুপ কফি’ও বলা হয়।

কেন একটা কফির নাম বিড়ালের নামে হবে? কেনই বা কফি লুয়াককে ক্যাট পুপ কফি ডাকা হয়?

তবে এই নামটি পুরোপুরি নির্ভুল নয়। যেহেতু সিভেটস, এশিয়া পাম সিভেটস আসলে বিড়াল নয়। এগুলো ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং ভিয়েতনামের মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সিভেটস গোত্রের প্রাণী। বাংলায় যার নাম গন্ধগোকুল।

কফি নিয়ে কথা বলতে বসে কেন একটা অপরিচিত প্রাণী সম্পর্কে কথা বলছি? সবগুলো প্রশ্নের উত্তরটা বেশ ধামাকাদার! কোপি লুয়াক সংগ্রহ করতে হয় এই পাম সিভেট প্রাণীটির মল (poop) থেকে!

এ কফি যে পদ্ধতিতে বানানো হয়, তা জানলে অবাক হবেন আপনি। এমনকি যদি একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়ে থাকেন, তাহলে কফিটা আপনার হয়তো খেতেই ইচ্ছে করবে না।

পাম সিবেট ক্যাট; Source: balibushire

চাষ করা কফির ফল খেতে দেওয়া হয় পাম সিবেটকে। তারা বেছে বেছে সবচেয়ে ভালো কফি ফলগুলোকে গিলে খেয়ে নেয়।  কিন্তু  বীজসহ কফি ফলের পুরোটা তারা  হজম করতে পারে না। কফি ফলের মাংসল অংশ হজম হয়ে গেলেও বীজগুলো আস্তই থেকে যায়। এর পরিপাক নালীর মধ্যে কফির বীজগুলোর গাঁজন হয়।  প্রটিএজ নামক এক ধরনের পাচক রস কফিশুটির মধ্যে প্রবেশ করে ক্ষুদ্রতর পেপটাইড এবং অন্যান্য মুক্ত অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি করে। এতে কফির বীজে যোগ হয় ক্যারামেলের ফ্লেভার বা এক প্রকারের সুগন্ধ। এই কারণেই লুয়াক কফির স্বাদ বেড়ে যায়। পরে পাম সিবেট মলত্যাগ করলে তা থেকে আস্ত বীজগুলো সংগ্রহ করেন কফিশ্রমিকেরা। আর সে বীজগুলো পরিষ্কার করেই তৈরি করা হয় সবচেয়ে দামি কফি।

কফি লুয়াক প্রস্তুত হবার জন্য অনেকগুলো স্টেজ পেরিয়ে আসে; Image Source: Martin Stokes/Coffee or Die

তবে এই পরিষ্কার করার কাজটিও কয়েকটি ধাপে করা হয়। প্রথমেই ভালো করে ধুয়ে নেওয়া হয় কফির বীজগুলো। তারপরে একটি উচ্চ তাপমাত্রায় (৪০০ ফারেনহাইটের বেশি তাপমাত্রায়) কফিগুলো ভেজে নেওয়া হয়। এছাড়াও কফিবীজের উপরের একটা লেয়ার তুলে ফেলার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাই এই প্রক্রিয়াগুলো নিশ্চিত করে যে কোপি লুয়াক পান করার জন্য শতভাগ নিরাপদ।


‘কপি লুয়াক’র উৎপাদক ইন্দোনেশিয়ায় এখন প্রচুর সিবেট ক্যাট পালন করা হচ্ছে। আর সেই সিবেট ক্যাটের মাধ্যমে উৎপাদন করা হচ্ছে সবচেয়ে দামি কফি। যেহেতু কোপি লুয়াক কফির কোনো প্রজাতি নয়। বরং কয়েকটি ধাপে প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে কফি উৎপাদিত হয়। সেজন্যই পুরো পৃথিবী জুড়ে প্রতিবছর ‘কপি লুয়াক’ উৎপাদন হয় মাত্র ২৫০ কেজি থেকে ৫০০ কেজি, যেখানে সাধারণ কফি প্রতিবছর উৎপাদন হয় ৯০০ মিলিয়ন টন।

আর সেই কারণেই খুচরা মূল্য হিসাবে একে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল কফির মধ্যে একটি বলা হয়েছে। যার প্রতি কেজির মূল্য ৫৫০-৭০০ মার্কিন ডলার, যা ফিলিপাইন-এর ব্লাক আইভরি কফির দামের কাছাকাছি। ইন্দোনেশিয়ার বৃহৎ সুপারমার্কেটে ফার্মজাত কোপি লুয়াকের দাম প্রতি কেজি মার্কিন$১০০ থেকে শুরু হয়। যা উচ্চ মানের স্থানীয় অ্যারাবিকা কফি থেকে পাঁচ গুন বেশি দাম।

ইন্দোনেশিয়ার বালির একটি ফার্মে লুয়াক বিন ভাজা হচ্ছে; Image Source: Martin Stokes/Coffee or Die

তবে আজকাল বন্য গন্ধগোকুলের মল সংগ্রহ করা হয় না। এটি ছিল পুরাতন পদ্ধতি। এর পরিবর্তে বেশি ব্যবসা করার জন্য কফি খামারে সিবেট ক্যাট লালন পালন করা হয়। বদ্ধ খাঁচায় লালন পালন করা পাম সিবেটকে  জোর করে কফিশুটি খাওয়ানো হয়।  এমনকি প্রাণীগুলো কোন ধরণের কফিশুটি খাবে, তা ব্যবসায়ীরা নির্বাচন করে। সাধারণত এসব ফার্মে যে ধরণের কফিশুটি ব্যবহার করা হয়, তা বন্য কফিশুটি তুলনায়  খারাপ মানের হয়।

কফি ফার্মে পাম সিবেটগুলো ভয়ঙ্কর দুরবস্থায় জীবন যাপন করে।  যেমন- একাকীত্বকরন, খারাপ খাদ্যাবস্থা, ছোট খাঁচা এবং উচ্চ মৃত্যুহারের কারণে বর্তমানে এই চাষ পদ্ধতি নিয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন উঠেছে। প্রথাগত চাষাবাদকারীরাও বানিজ্যিক গন্ধগোকুল চাষ পদ্ধতির সমালোচনা করেন। ট্রাফিক সংরক্ষণ প্রোগ্রাম এর একজন কর্মকর্তার মতানুসারে, কোপি লুয়াক তৈরিতে পাম সিবেট বাণিজ্য, বন্য পাম সিবেটের জনসংখ্যার উপর উল্লেখযোগ্য হুমকি হিসাবে দেখা দিতে পারে। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে কফি লুয়াকের স্বাদ তেমন ভালোও নয়।

ইন্দোনেশিয়ার বালিতে বিভিন্ন ধরণের কফি; Source: world travel connector

বর্তমান সময়ে খোদ ইন্দোনেশিয়ায় গিয়েও বন্য পাম সিবেটের আসল কোপি লুয়াক কিনতে পারা খুবই কঠিন কাজ। কারণ নকল কোপি লুয়াকের মধ্য থেকে আসল কোপি লুয়াক পৃথক করে চেনা সহজ নয়।

প্রক্রিয়াজাতকরণে ভালোমন্দ দুটোই থাকার পরেও অভিনব উপায়ে তৈরি হও্য়া কপি লুয়াক কফিপ্রেমীদের কাছে খুবই প্রিয়।

কোপি লুয়াক প্রধানত ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপমালার সুমাত্রা, জাভা, বালি এবং সুলাবেসি দ্বীপগুলোতে উৎপাদিত হয়। ইন্দোনেশিয়ার কফির এই ফার্মগুলোতে গেলে বিশ্বের সবচেয়ে দামি কফি লুয়াক উৎপাদনকারী এই বিখ্যাত প্রাণিটিকেও কিন্তু দেখতে পাওয়া যাবে।


Post a Comment

0 Comments