পৃথিবীতে এতো ব্যাংক থাকার পরও সুইস ব্যাংক কেনো বিখ্যাত?

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় 


ব্যাংক


অনলাইন ডেস্ক

০৪ অগ্রহায়ণ,১৪২৯ বঙ্গাব্দ,শনিবার -১৯ই নভেম্বর-২০২২ খ্রিস্টাব্দ,২৪ই রবিউস সানি,১৪৪৪ হিজরি,হেমন্তকাল;


সুইস ন্যাশনাল

 ব্যাংক (এসএনবি) (ইংরেজি: Swiss National Bank) হল সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যেটি দেশের মুদ্রানীতি প্রণয়ন এবং ব্যাংকনোট সুইস ফ্র্যাঙ্ক ইস্যু ও প্রচলন করে। সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক বিশেষ ফেডারেল আইনের অধীনে গঠিত শেয়ার মালিকানার দ্বারা সীমাবদ্ধ একটি ব্যাংক কোম্পানি। এর দুটি প্রধান কার্যালয় রয়েছে, যার একটি বার্নে এবং একটি জুরিখে অবস্থিত।

বার্নের বুন্দেস প্লাটজে সদর দফতর।

ইতিহাস

১৯০৭ সালের ৬ জুন ইস্যু করা সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের শেয়ার

১৮২৬ সাল নাগাদ সুইজারল্যান্ডে ব্যাংকের সংখ্যা দাড়ায় ৫৩টি। ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর প্রয়োজনীয়তার ফলস্বরূপ ব্যাংকটি গঠিত হয়েছিল। ১৮৭৪ সালে ফেডারেল সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যাংকনোট ইস্যু ও প্রচলন সম্পর্কিত আইন তদারকি করার ব্যবস্থার জন্য বলা হয়। পরবর্তীতে, ১৮৯১ সালে পুনরায় সংবিধানের সংশোধনীতেও ব্যাংকনোট ইস্যু ও প্রচলন তদারকি করার জন্য একটি মাত্র স্বাধীন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান গঠনের উল্লেখ করা হয়। ফলশ্রুতিতে, 'ন্যাশনাল ব্যাংক অ্যাক্ট'-এর উপর ভিত্তি করে ১৯০৬ সালে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় যা ১৯০৭ সালে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করে।

সুইজারল্যান্ডের ফেডারেল কাউন্সিলের নির্দেশে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে (১৯১৪-১৯১৭)  সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক প্রথমবারের মতো ক্ষুদ্র সংখ্যার নোট প্রকাশ করে। ব্যাংক নোট ডিজাইনের জন্য ১৯৮১ সালে সুইস ব্যাংক 'ওরেল ফ্যাসলি' এবং 'ল্যান্ডিস গির' নামক অপটিক্যাল গবেষণা গ্রুপের সাথে একটি যৌথ গবেষণায় পরিচালনা করে। ১৯৯৪ সালে এটি একটি যৌথ মূলধনী কোম্পানি হিসাবে নিবন্ধিত হয়। ২০০৪ সালে মে মাসে ফেডারেল সংবিধানের ৯৯নং অনুচ্ছেদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাংকটি আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন লাভ করে।

মালিকানাঃ-

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের শেয়ার মূলধনের প্রায় ৫৫% রয়েছে সুইস কনফেডারেশনের বিভিন্ন সংযুক্ত এস্টেট, ক্যান্টনাল ব্যাংকসহ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে। বাকি শেয়ারগুলি মূলত ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। এসএনবি'র শেয়ার ১৯০৭ সাল থেকে এসএআইএক্স সুইস এক্সচেঞ্জে-এর তালিকাভুক্ত হয়।

দায়িত্ব

১৯১৪ সালে প্রচলিত ৫ সুইস ফ্র্যাঙ্ক-এর চিত্র

ফেডারেল সংবিধানের ৯৯নং অনুচ্ছেদে ব্যাংকের বেসিক গভর্নিং নীতিগুলি সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। উক্ত অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের মূল দায়িত্ব হচ্ছে মুদ্রানীতি সম্পর্কিত বিষয়গুলি নিয়ে কাজ করা অর্থাৎ মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও প্রচলন করা। সংবিধানের বাধ্যবাধকতায় এই ব্যাংক সর্বদা সুইজারল্যান্ডের অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কাজ করবে। তদনুসারে, এই ব্যাংকের প্রধান কাজটি হ'ল:

নোট ইস্যু এবং বিতরণঃ-

নোট ইস্যু করার একমাত্র অধিকার এ ব্যাংকের হাতে। তাই অর্থনীতির অবস্থা বিবেচনায় ও তারল্য নিশ্চিতকল্পে এটি ব্যাংক নোট ইস্যু ও সরবরাহ করে। ধাতব মুদ্রা বিতরণের দায়িত্বও এই ব্যাংক পালন করে থাকে।

বৈদ্যুতিক লেনদেন পরিচালনাঃ-

সুইস ইন্টারব্যাঙ্ক ক্লিয়ারিং (এসআইসি) পদ্ধতির মাধ্যমে দেশের অন্যান্য ব্যাংকসমূহের আন্ত ব্যাংক লেনদেন সম্পূর্ণ করতে সহায়তা করা এই ব্যাংকের অন্যতম দায়িত্ব।

বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ও বিনিয়োগঃ-

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সংরক্ষণ ও পরিচালনা করে। এছাড়া, মজুদকৃত বৈদেশিক মুদ্রা বিভিন্ন মেয়াদে বিভিন্ন স্টকে বিনিয়োগ করে থাকে।

আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতাঃ-

আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতায় বজায় রাখা এই ব্যাংকের অন্যতম দায়িত্ব।

আন্তর্জাতিক আর্থিক সহযোগিতাঃ-

ফেডারেল কর্তৃপক্ষ এবং সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক যৌথভাবে আন্তর্জাতিক আর্থিক সহযোগিতামূলক কার্যক্রমে অংশ নেয় এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে।

কনফেডারেশনের ব্যাংকারঃ-

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক সুইস কনফেডারেশন তথা সরকারের ব্যাংকার হিসাবে কাজ করে। এটি কনফেডারেশনের পক্ষে অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা করে, মানি মার্কেটের বন্ড ইস্যু করে, অর্থের বাজার এবং বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন পরিচালনা করে।

নীতিসমূহঃ-

বিনিয়োগ নীতি

বার্নের এক জলবায়ু প্রদর্শনীতে (২০১৯) সুইস ন্যাশনাল ব্যাংককে জীবাশ্ম জ্বালানী বিষয়ক প্রদর্শনী।

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক এর সম্পদ সাধারণত শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে থাকে। ২০১৮ সালে, ব্যাংকের শেয়ার বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১৫৩ বিলিয়ন সুইস ফ্র্যাঙ্কে দাঁড়ায়।

মুদ্রানীতিঃ-

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতায় রক্ষার জন্য মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও পরিচালনা করে। এসএনবি-এর মুদ্রানীতির তিনটি উপাদান রয়েছে যথাঃ মূল্য স্থিতিশীলতা; মধ্যমেয়াদী মুদ্রাস্ফীতি পূর্বাভাস; এবং সুদের হারের লক্ষ্যসীমা নির্ধারণ করা। এই তিন উপাদান বা নীতির উপর ভিত্তি করেই সুইস ব্যাংক মুদ্রানীতি পরিচালনা করে।

পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ

শেয়ারহোল্ডারদের সাধারণ সভাঃ-

শেয়ারহোল্ডারদের সাধারণ সভা বছরে একবার, সাধারণত এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত হয়।

ব্যাংক কাউন্সিলঃ-

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবসায় পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ একটি 'ব্যাংক কাউন্সিল' এর উপর অর্পিত থাকে যেটি ১১ জন সদস্য নিয়ে গঠিত। ব্যাংক কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টসহ ৬ জন সদস্য ফেডারেল কাউন্সিল মনোনীত এবং ৫ জন সদস্য শেয়ারহোল্ডার মিটিং দ্বারা নিযুক্ত হন। ব্যাংক কাউন্সিল নিজস্ব পর্যায় থেকে চারটি কমিটি গঠন করে। কমিটিগুলো হচ্ছে- নিরীক্ষা কমিটি, ঝুঁকি কমিটি, পারিশ্রমিক কমিটি এবং নিয়োগ কমিটি।

পরিচালনা পর্ষদঃ-

এই ব্যাংকের পরিচালনা ও কার্যনির্বাহী কমিটিকে বলা হয় 'পরিচালনা পর্ষদ'। পরিচালনা পর্ষদ বিশেষত মুদ্রানীতি প্রণয়ন, সম্পদ পরিচালনার কৌশল, আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক সহযোগিতা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ তিন সদস্য সমন্বয়ে গঠিত:

  • চেয়ারম্যান: টমাস জর্ডান 
  • ভাইস চেয়ারম্যান: ফ্রিটজ জুরব্র্যাগ
  • সদস্য: আন্দ্রে এম. মেচলার

পরিচালনা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যানগণের তালিকা-

  • হেনরিচ কুন্ডার্ট (১৯০৭-১৯১৫);
  • আগস্ট বার্কার্ড (১৯১৫-১৯২৪);
  • গোটলিব বাচম্যান (১৯২৫-১৯৩৯);
  • আর্নস্ট ওয়েবার (১৯৩৯-১৯৪৭);
  • পল কেলার (১৯৪৭-১৯৫৬);
  • ওয়াল্টার শোয়েলার (১৯৫৬-১৯৬৬);
  • এডউইন স্টপার (১৯৬৬-১৯৭৪);
  • ফ্রিটজ লেউটওয়লার (১৯৭৪-১৯৮৪);
  • পিয়ের লাঙ্গুয়েটিন (১৯৮৫-১৯৮৮);
  • মার্কাস লুজার (১৯৮৮-১৯৯৬);
  • হান্স মায়ার (১৯৯৬-২০০০);
  • জিন-পিয়েরে রোথ (২০০০-২০০৯);
  • ফিলিপ হিলডেব্রান্ড (২০১০-২০১২);
  • থমাস জে জর্ডান (২০১২ থেকে বর্তমান)।

সমালোচনাঃ-

গ্রাহকের গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোর সুনাম রয়েছে। কর ফাঁকি দেয়া, কিংবা দুর্নীতি বা অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ রাখার জন্য 'ট্যাক্স হ্যাভেন' হিসেবে সুইস ব্যাংকগুলো দুর্নামও রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক এই বিষয়ে কোন ধরনের পদক্ষেপ নেয় না বলে কঠোর সমালোচিত এই ব্যাংক। যদিও আইনের বাধ্যবাধকতা এবং দেশের কঠোর ব্যাংকিং নিরাপত্তার নীতিমালার কারনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়েও এই ব্যাংকের তেমন কিছুই করার নেই বলে জানা যায়। বিশ্বের অনেক দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক, ব্যবসায়ী বা নামকরা তারকা সুইস ব্যাংকে তাদের অর্থ পাচার করে আসছেন। সুইস ব্যাংকগুলোতে এই ধারা শুরু হয় মূলত ১৯৩০ এর দশকে, যখন জার্মানির ইহুদীরা নাৎসীদের শুদ্ধি অভিযানের মুখে পড়ে, তখন তাদের অর্থ গোপন ব্যাংক একাউন্টে রাখার জন্য সুইস ব্যাংকগুলোকে বেছে নেয়। এতেকরে ব্যাংকগুলো একধরণের ব্যবসাইক সুবিধা হাসিল করে। পরবর্তীতে, ফ্রান্সের কয়েকজন রাজনীতিক এবং ব্যবসায়ী তাদের বিপুল অর্থ সুইস ব্যাংকে রেখেছিলেন। সেই তথ্য ব্যাংক থেকে ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। এরপর ১৯৩৪ সালে সুইস ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের গোপনীয়তা রক্ষার জন্য কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই গোপনীয়তা আইনের সুযোগে সুইটজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো অবৈধ অর্থ রাখার বিশেষ জায়গা বা 'ট্যাক্স হ্যাভেন'-এ পরিণত হয়েছে। ফলে তৃতীয় বিশ্বের দুর্নীতিবাজ স্বৈরশাসক থেকে শুরু করে ইউরোপ-আমেরিকার কর ফাঁকি দেয়া বিত্তশালী ব্যবসায়ী, সবাই তাদের অর্থ গোপন রাখার জন্য বেছে নেন সুইস ব্যাংকগুলোকে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুইটজারল্যান্ডের ওপর চাপ বেড়েছে এরকম অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।

বিদেশিদের আমানতঃ-

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী ব্যাংক গ্রাহকদের গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করা হয়। ফলে নাম পরিচয় গোপন রেখে বিভিন্ন দেশের ধনীরা সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন। ২০০২ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচার রোধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ব্যাপকভাবে কার্যকর হওয়ায় বার্ষিক ভিত্তিতে জমা টাকার হিসাব প্রকাশ করে সুইজ ন্যাশনাল ব্যাংক। ২০২২ সালের ১৬ জুন এই ব্যাংক বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে দেশটিতে থাকা বিভিন্ন ব্যাংকে ২০২১ সালের শেষে বিদেশিদের আমানতের পরিমাণ প্রকাশিত হয়,যা নিম্নরূপ :

  • বাংলাদেশি নাগরিকদের আমানতের পরিমাণ ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ ( ৮৩৩১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, প্রতি সুইস ফ্রাঁ ৯৫.৬৫ টাকা হিসাবে )।
  • ভারতীয়দের জমানো অর্থের ৩৮২ কোটি ৮৯ লাখ ফ্রাঁ।
  • মার্কিন নাগরিকদের জমানো অর্থের পরিমাণ ১৬৭৩৩ কোটি ফ্রাঁ।
  • রাশিয়ার নাগরিকদের জমানো অর্থের পরিমাণ ২১৩৭ কোটি ফ্রাঁ।
  • শ্রীলঙ্কার জমানো অর্থের পরিমাণ ৫ কোটি ৬০ লাখ ফ্রাঁ।

বিশ্বের মধ্যে সুইস ব্যাংকগুলোতে ৩৭৯ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ জমা রেখে তালিকার শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাজ্য। এরপরই ১৬৮ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ জমা রেখে দ্বিতীয় অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। তালিকার শীর্ষ ১০ এ থাকা অন্য দেশগুলো হলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জার্মানি, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, হংকং, লুক্সেমবার্গ, বাহামাস, নেদারল্যান্ডস ও কেম্যান।

সূত্রঃউইকিপিডিয়া

Post a Comment

0 Comments