ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামক দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল বাংলা সন ১১৭৬-এ (১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে)।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হিসেবে পরিচিত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। ১৭৬৫ সালে ইংরেজরা দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। বাংলার নবাবের হাতে থাকে নামে মাত্র প্রশাসনিক ক্ষমতা।
রাজস্ব আদায় এবং আয়-ব্যয়ের হিসাব থাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে। ফলে যে শাসনব্যবস্থার সৃষ্টি হয় ইতিহাসে তা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত। ক্ষমতাহীন নবাবের প্রশাসনিক শাসনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি খাজনা আদায়ের নামে সীমাহীন শোষণ আর লুণ্ঠন শুরু করে।
এর পরের ঘটনা আর ইতিহাসে অজানা নয়। সেই ৭৬ এর দুর্ভিক্ষের কয়েকটি কারন ছিল :
❌ দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা: মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজস্ব বা দেওয়ানী আদায়ের অধিকার লাভ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে তার রাজনৈতিক, প্রশাসনিক আধিপত্য কায়েম করে।
পূর্বের যাবতীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে কোম্পানি সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে মুদ্রার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের বন্দোবস্ত করে এবং রাজস্ব সময়মতো এবং পরিমাণমতো আদায়কৃত না হলে কৃষককে জমি থেকে উচ্ছেদ করার নীতি প্রবর্তন করে। ফলে অধিক পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের জন্য কোম্পানির কর্মকারীরা কৃষকদের উপর মাত্রাতিরিক্ত জুলাম চালাতে থাকে।
❌ নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব : জমিদার নামে পরিচিত জমির মালিকদের এ সময় কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়। এদের কর্তব্য হলো কৃষকদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে কোম্পানির কাছে তা জমা দেওয়া।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, এই জমিদার শ্রেণি নিজেদের ব্যক্তিগত মুনাফা বৃদ্ধির জন্য কৃষকদের ওপর ব্যাপক হারে অত্যাচার করে অধিক মাত্রায় রাজস্ব আদায়ে শুরু করে। এই অত্যাচারী রাজস্ব আদায়কারী মধ্যে রেজা খাঁ ও সিতাব রায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্বের পরেও সরকারকে বিশেষ নজরানা বা ভেট দিত, যা দরিদ্র কৃষদেরর কাছ থেকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আদায় করা হতো।
❌ প্রাকৃতিক কারন : বাংলা ও বিহারে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ১৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে যে অনাবৃষ্টি দেখা দেয় তা চলে প্রায় ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যার অনিবার্য পরিণামে দেখা দেয় খরা ও শস্য ঘাটতি। এই অনাবৃষ্টির সূচনা কাল থেকেই ব্রিটিশ বণিকরা শস্য উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে তা প্রচুর পরিমাণে স্বল্প দামে ক্রয় করে মজুদ করে রাখে। এরপর যখন দীর্ঘকালীন অনাবৃষ্টিতে খরা দেখা দেয়, তখন ওই মজুদ করে রাখা শস্য তারা অত্যন্ত উচ্চ হারে বিক্রয় করতে শুরু করে।
খাজনার উচ্চহার এবং সেইসঙ্গে উচ্চমূল্যের শস্য ক্রয় করা দরিদ্র কৃষকের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠলে এর অনিবার্য পরিণতিতে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। এছাড়া সে বছর অত্যধিক বৃষ্টিপাত ও বন্যার গ্রাস থেকে কৃষক ফসল ঘরে তুলতে পারে নি। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের তথা বাংলার ১১৭৬ সনের এই তীব্র দুর্ভিক্ষের প্রকোপে বাংলা বিহারের বহু মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।
উল্লেখ্য, ব্রিটিশরাজের কোম্পানি শাসকরা পুরো বিষয়টিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে দাবি করে। কিন্তু ভিন্ন সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, ১৭৬৮ সনে আদায়কৃত রাজস্ব ১৫.২১ মিলিয়ন রুপির চেয়ে ১৭৭১ সনের আদায়কৃত রাজস্বের পরিমাণ ৫,২২,০০০ রুপি বেশি ছিল, অথচ এর আগের বছরেই ঘটে যায় দুর্ভিক্ষ।
0 Comments
আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ।